টেকনাফের সাবরং বাহারছড়া ফয়জুল উলুম মাদরাসার মাঠে চল্লিশ ডেক খাবার রান্না হচ্ছে। তাগড়া দেখে দুটো গরু জবাই হয়েছে সন্ধ্যাবেলা। পর্যাপ্ত পরিমাণ বোতলজাত পানি আর খাবার স্যালাইন মজুদ করা হয়েছে মাদরাসার বারান্দায়। অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধ আর কাপড়ও আছে ওখানে। কালকে সব পৌঁছে যাবে আরাকান থেকে আগত নিরণ্ন শরণার্থীদের হাতে।
এরই মধ্যে একটি ট্রাক এসে থামলো মাদরাসার সামনে। মাদরাসার বারান্দায় বসেছিলেন গাজী ইয়াকুব। ট্রাক থামতেই এগিয়ে গেলেন। ট্রাকভর্তি ছোট বড় শ’খানেক কার্টন। মাদারাসার ভলান্টিয়ারদের দিয়ে কার্টনগুলো নামাতে লাগলেন। একটি কার্টন খুলে ভেতরে উঁকি দিলেন ইয়াকুব ভাই- ভেতর থেকে বের করে আনলেন একটি কালো বোরকা। বোরকাটির দিকে তাকিয়ে ইয়াকুব ভাইয়ের ভেতর থেকে একটি হতাশ্বাস বেরিয়ে এলো- আহা! যদি আরও টাকার ব্যবস্থা করা যেতো, সব রোহিঙ্গা নারীর আব্রু ঢাকার কাপড়ের ব্যবস্থা যদি করতে পারতাম!
০২
এবারকার কুরবানির ঈদের আগে যখন নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হলো, ইয়াকুব ভাই একা চলে গিয়েছিলেন টেকনাফ। যাওয়ার আগে ঈদের কেনাকাটা আর স্ত্রীর জমানো হাতখরচ মিলিয়ে ৮১ হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলো দিয়েই প্রাথমিক ত্রাণ বিতরণ শুরু করেন।
তিনি মাত্র ৮১ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করেছিলেন। কাল জানালেন, এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি টাকার ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তাঁর তত্ত্বাবধানে।
‘ কোথা থেকে এসেছে এ-সব টাকা?’-এমন প্রশ্নের জবাবে হাসিমুখে জানালেন, ‘টাকা কোত্থেকে আসছে বা কতো আসছে, আমি সেসবের খবরও জানি না। এ মাদরাসার অফিসের সামনে একটি বড় ব্যাগ টাঙিয়ে রাখা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে আসা লোকজন যার যতো ইচ্ছা ওই ব্যাগে রেখে যায়। কখনো পরিচিতজনরা ফোন করে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
এসবই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসার টাকা। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রত্যেকটি বাঙালির সমব্যথী সহযোগিতা।’
০৩
‘শাহপরী থেকে প্রায় ৮-১০ মাইল দূরবর্তী সাগরের মাঝে একটি দ্বীপে আটকা পড়ে আছে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা। সেখানে তারা ১০-১৫ দিন থেকে না খেয়ে অবস্থান করছে। ক্ষুধার তাড়নায় লতাপাতা খেয়ে জীবনধারণ করছে। তাদের খবর কেউ জানে না। সেখানে তারা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কাল কয়েকটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করে পর্যায়ক্রমে তাদের এখানে নিয়ে আসবো।’ বলছিলেন গাজী ইয়াকুব।
নাফ নদী পার হয়ে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তাদের অধিকাংশই নারী। এদের মধ্যে কমবয়সী মেয়েরা যেমন আছে তেমনি আছে যুবতী এবং বিবাহিত নারীরাও।
স্থানীয় অনেক টাউট-বাটপার লোকজন এসব নারীদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায়। নারীদের অসহায় পেয়ে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটছে।
তিনি জানালেন, রোহিঙ্গা নারীরা অনেক ধর্মপরায়ণ। পর্দা-পুশিদার ব্যাপারে অনেক সচেতন। কিন্তু এখন ভাগ্যের দুর্বিপাকে তারা শরণার্থী হয়ে এদেশে চলে এসেছে। ইচ্ছা থাকলেও জীবন বাঁচানোর স্বার্থে স্বাভাবিক পর্দা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এ দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি রোহিঙ্গা নারীকে আমরা একটি করে বোরকা হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি, যাতে করে তারা নিজেদের আব্রুর হেফাজত করতে পারে।
তিনি জানালেন, ‘আমরা প্রায় দুই হাজার রোহিঙ্গা নারীকে বোরকা দিয়েছি। তবে এ উদ্যোগ আরও সম্প্রসারিত করা হচ্ছে। আমাদের ইচ্ছা, কমপক্ষে ১০ লাখ টাকার বোরকা বিতরণ করার। বাদবাকি যদি মানুষের কাছ থেকে আরও সাহায্য পাই তবে আরও মানুষকে সহযোগিতা করার জন্য আমি সর্বদা প্রস্তুত।’
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আর স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতাই সবচে বেশি হচ্ছে। বিশেষত স্থানীয় জনগণের সহযোগিতার কথা বলতেই হবে। প্রতিটি বাড়িতে বড় বড় ডেগচিতে শরণার্থীদের জন্য সন্ধ্যাবেলা রান্না করা হয়। যে যেভাবে পারছে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। তবে তা আগত পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার জন্য এখনও অপর্যাপ্ত। আরও অনেক সহযোগিতার প্রয়োজন।’
০৪
গাজী ইয়াকুব প্রায় মাসখানেক ধরে পড়ে আছেন টেকনাফের পাহাড়ি অঞ্চলে। যখনই কোথাও কোনো অসহায় রোহিঙ্গার খবর পান, ছুটে যান নিজের সর্বস্ব সম্বল নিয়ে। একজন অসহার নারী বা শিশুর কান্না তার পিতৃহৃদয়ে শেলের মতো বেজে ওঠে সর্বক্ষণ। তাঁর ঘুম নেই, ঠিকমতো খাওয়া নেই; কিন্তু অসহায় শিশুদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার তাড়নায় নিরলস ছুটে চলেছেন টেকনাফের পাহাড়-সমুদ্রে। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখের এক টুকরো হাসির মাঝে তিনি দেখতে পান তার সন্তানের হাসিমাখা মুখচ্ছবি।
এই পৃথিবীতে যৌবনদীপ্ত যুবকের অভাব নেই, কিন্তু যুদ্ধের যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় অনেকেরই হয় না। ইয়াকুব ভাই সেই শ্রেষ্ঠ যুবকদের মিছিলের আগুয়ান সেনানী, যুদ্ধের ময়দানে যিনি বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান অকুতোভয়ে।
গাজী ইয়াকুবের মত শত শত তরুণ আলেমে দ্বীন দিনের পর দিন আরাকানি ভাইদের সহযোগিতায় নিয়মিত শ্রম দিচ্ছেন। তাদের সহযোগিতায় নিজেদের সময় ও অর্থ ব্যয় করছেন।