আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগেকার কথা। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন আল্লাহর একজন প্রিয় নবী। আল্লাহতায়ালার সঙ্গে গভীর ভালোবাসায় এত একাÍ হয়ে গিয়েছিলেন যে স্রষ্টার আদেশ-নির্দেশ ছাড়া কোনো কিছুই তিনি বুঝতেন না।
এ কারণে আল্লাহতায়ালা তাকে নিজের বন্ধু (খলিল) বলে সম্বোধন করেছেন। সে কারণে তার নাম হয়েছিল ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ। তিনি প্রথম সারা বিবিকে বিয়ে করেন। কিন্তু তাদের কোনো সন্তানাদি না হওয়ার কারণে সারা বিবি নিজেই নবী ইব্রাহিমকে আরও একটা বিয়ে করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ইব্রাহিম (আ.) তখন প্রায় বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। অতঃপর তিনি বিবি হাজেরাকে বিয়ে করেন। কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা তাদের এ শেষ বয়সে তখন ইব্রাহিম (আ.) সারা ও হাজেরা উভয়ের গর্ভে দুই পুত্র লাভ করেন। সারা বিবির গর্ভের ছেলের নাম ইসহাক এবং বিবি হাজেরার গর্ভের ছেলের নাম ইসমাইল। তারা তখন কেনানে (বর্তমানে ফিলিস্তিন এলাকায়) বসবাস করতেন। এ সময়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট হন যে হাজেরা বিবিকে তার ছোট্ট শিশু ইসমাইলসহ নির্বাসনে পাঠাতে হবে।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার প্রাণপ্রিয় শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) ও বিবি হাজেরাকে নিয়ে মক্কার উষর পাহাড়-পর্বত সংকুুল জনমানবহীন বিরান এক পাহাড়ি উপত্যকায় নির্বাসন দিয়ে যান। সঙ্গে সামান্য কিছু খেজুর ও পানি। কিন্তু জায়গাটা এমন যে সেখানে কোনো লোকালয় তো ছিলই না, এমনকি সেখানে কোনো লোকজনের যাতায়াতও ছিল না। তাই খাদ্যদ্রব্য বা পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
এ জায়গাটার বর্ণনা পাওয় যায় কোরআন শরিফে। নির্বাসনে রেখে যাওয়ার সময় আল্লাহর কাছে ইব্রাহিম (আ.) যে দোয়া করেছিলেন তা হচ্ছে-‘হে আমাদের মালিক, আমি আমার পরিবারকে তোমার পবিত্র ঘরের কাছে একটি অনুর্বর উপত্যকায় এনে আবাদ করলাম, যাতে করে- হে আমাদের মালিক এরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তুমি (তোমার দয়ায়) এমন ব্যবস্থা কর, যেন মানুষের অন্তর এদের দিকে অনুরাগী হয়, তুমি ফলমূল দিয়ে তাদের রিজিকের ব্যবস্থা কর, যাতে ওরা তোমার নেয়ামতের শোকর আদায় করতে পারে’ (সূরা ১৪ ইব্রাহিম আয়াত ৩৭)।
অল্প কিছুকাল পরই তাদের আহার ও পানি যখন নিঃশেষ হয়ে গেল, তখন বিবি হাজেরা ও দুগ্ধপোষ্য শিশু হজরত ইসমাইল (আ.) ক্ষুধা ও পিপাসায় কষ্ট পেতে লাগলেন। আস্তে আস্তে তাদের অবস্থা কাতর হয়ে উঠল। দুগ্ধপোষ্য শিশু হজরত ইসমাইলের জীবন সংশয়। কিন্তু সেখানে পানি কোথায় অন্বেষণ করবেন বিবি হাজেরা। আল্লাহ পাকের ওপর তাওয়াক্কুল করে পানির অন্বেষণে বের হলেন তিনি। সাফা পাহাড়ে আরোহণ করলেন চতুর্দিকে তাকালেন পানির সন্ধান মেলে কিনা। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন কাছেরই একটা পাহাড়ে (মারওয়া) চিকচিক করছে পানি।
তিনি ছুটে গেলেন সেই পাহাড়ের দিকে। সে পাহাড়ের দিকে ছুটে যাওয়ারকালে শিশুপুত্রের দিকেও খেয়াল রাখছেন তিনি। দু’পাহাড়ের উপত্যকার ঢালে চলার সময় শিশুপুত্র আড়াল হয়ে পড়লে দ্রুত পার হলেন পানির উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন পানি কোথায় আসলে প্রখর রৌদ্র তাপে প্রস্তরময় বালুকারশিতে মরীচিকার সৃষ্টি হয়ে পানির আকার হয়েছিল মাত্র।
আবার তাকালেন চতুর্দিকে, এবার দেখতে পেলেন প্রথম পাহাড় সাফাতেই তো পানি দেখা যাচ্ছে। আবার একইভাবে ছুটে গেলেন সাফা পাহাড়ের দিকে। সেখানেও একই অবস্থা মরীচিকার খেলা। এভাবে একবার নয়, দু’বার নয়, সাতবার দুই পাহাড়ের মাঝে দৌড়ানোর পর শ্রান্ত-ক্লান্ত বিবি হাজেরা দেখতে পেলেন শিশু ইসমাইলের পায়ের আঘাতে তারই পাদদেশে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি দৌড়ে গেলেন শিশুপুত্রের কাছে। এবার তিনি দেখতে পেলেন, হ্যাঁ সত্যি সত্যি পানি। শিশুপুত্রের পায়ের গোড়ালির কাছে বিবি হাজেরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেলেন পানির প্রবাহ। আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করলেন।
পানি যাতে চলে না যায় তাই আশপাশ থেকে পাথর ও বালু এনে পানির উৎসের চারপাশে বাঁধ দিয়ে আটকালেন এবং উৎসাহের আতিশয্যে পানিকে ‘জমজম’ অর্থাৎ ‘থাম থাম’ বললেন। আল্লাহতায়ালার কুদরতে অমনি পানি স্থির হয়ে একটি ছোট্ট কূপের সৃষ্টি হয়ে গেল। সেই থেকে আজ অবধি সে কূপের নাম জমজম হয়ে রইল এবং এখনও সেটার প্রবাহ অবিরাম ধারায় রয়েছে।