হজ মৌসুমে মুমিন মুসলমানদের মাঝে অদম্য স্পৃহা ও ঈমানি চেতনা জাগ্রত হয়। পৃথিবীর নানা দেশের নানা প্রান্তের মানুষ এ উপলক্ষে আত্মশুদ্ধির অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’- ধ্বনিতে মুখরিত হয় মক্কা মোকাররমা, মদিনা মোনাওয়ারা আর আরাফাতের পবিত্র প্রান্তর।
রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত আরব ভূমিতে হজব্রত পালনের জন্য এবার বাংলাদেশ থেকে ব্যালটি, নন-ব্যালটি প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজারের অধিক হজযাত্রী হজ কাফেলায় যোগ দিচ্ছেন।
২৪ জুলাই হজ ফ্লাইট শুরু হয়েছে এবং চলবে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত। হাজীরা কখন মহানবীর (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত মক্কা-মদিনায় পৌঁছাবেন সে আকাক্সক্ষায় ফ্লাইট ধরার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন।
কিন্তু দুঃখজনক হল, প্রতীক্ষা শেষে বিমানবন্দরে পৌঁছে হাজীরা দেখতে পান তাদের পার্সপোর্ট নেই, মোয়াল্লেম নেই, বাস নেই, থাকার জায়গা নেই, মাল-সামান নেই, চিকিৎসাসেবা নেই, ফ্লাইটের নিশ্চয়তা নেই, টয়লেট সুবিধা নেই। এ রকম হাজারো সমস্যায় প্রতিনিয়ত জর্জরিত হচ্ছেন আল্লাহর মেহমান হাজীরা। ২০ বছর ধরে আমরা বিমানবন্দরে হাজীদের এ রকম দৃশ্য পত্রপত্রিকার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করে আসছি।
হজ যাত্রীর দুর্ভোগের অতীত দিনগুলোর কথা আমরা ভুলে যাইনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হজযাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের যে চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করেছি- তার প্রতিকার এখনও হয়নি। কর্মকর্তাদের অবহেলা, হজ সংক্রান্ত জটিলতা এবং হজ করতে না পারার চিন্তায় কত হজযাত্রী বিমানবন্দর থেকে প্রতারিত হয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন তা বর্ণনাতীত। কয়েক বছর আগে হজে যাওয়ার অনিশ্চয়তায় চিন্তিত হয়ে বিমানবন্দরে সুজাত আলী নামে যে হজযাত্রী মারা গেলেন তার মর্মবেদনা এখনও আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এ বছর হজযাত্রীরা নিরাপদে, নিশ্চিন্তে হজে যেতে পারবেন কিনা কে জানে? বাংলাদেশের সম্মানিত হজযাত্রীদের প্রতি আমাদের এ নামসর্বস্ব দায়িত্ব নিতান্তই গ্লানিকর।
পবিত্র মক্কার পথিক হওয়ার বাসনা মুসলমানের চিরকালীন বিষয়। বিশেষ করে, বহু নবীর পূর্বপুরুষ তথা ‘জাদ্দুল আম্বীয়া’ হিসেবে খ্যাত হজরত ইবরাহিম খলিলুল্লাহ (আ.) থেকে শুরু করে রাসূল (সা.)-এর যুগ থেকে কোটি কোটি তাওয়াফকারীর পদচারণায় মুখরিত মক্কা। মহান আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে কাফন পরিধান করে ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ বলে দিগ-দিগন্ত থেকে ছুটে আসে পৃথিবীর নানা দেশের নানা প্রান্তের কাবা প্রেমিক মানুষ। কাবার পথিকদের না আছে রাতের পরোয়া, না আছে শীত-গ্রীষ্মের পরোয়া, না আছে পথেঘাটে বাধা-বিপত্তি কিংবা জানমালহানির পরোয়া। অর্থ-সম্পত্তি, আপন দেশ, আপন পরিবার পরিজনের মায়া-মমতা, সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে বিভোর হয়ে তারা ছুটে চলেন কাবার পথে।
কবি নজরুল যথার্থই বলেছেন- ‘চলরে কাবার জেয়ারতে, চল নবীজীর দেশ।/ দুনিয়াদারীর লেবাস খুলে র্প রে হাজীর বেশ।’
কাবার পথ কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রাচীনকালে হজযাত্রা ছিল নিতান্তই দুর্গম ও কষ্টসাধ্য, অনেকটা অন্তিমযাত্রার মতো। হেঁটে কিংবা ক্ষীণকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূরদূরান্ত থেকে নানা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে মানুষ হজে আসত। কষ্ট স্বীকার করে হজে আসার কথা কোরআনেও বলা হয়েছে- এভাবে এবং মানুষের মধ্যে হজের সাধারণ ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার নিকট উপস্থিত হবে পদব্রজে ও প্রত্যেক ক্ষীণকায় উটনীর পিঠে করে, যা দূরদূরান্তের পথ থেকে আসে।-(সূরা : আল হাজ, আয়াত : ২৭)
ইতিহাসের পাতায় পৃথিবীর নানা দেশের নানা বর্ণের ও গোত্রের মানুষের অনেক কষ্ট ও দুর্দশাক্লিষ্ট হজ ইতিবৃত্ত লেখা আছে। যাত্রাকালে হাজীদের অন্তিম বিদায় দেয়া হতো। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও আপনজনেরা হজ উপলক্ষে হাজীদের আঙ্গিনায় জমায়েত হয়ে চোখের জলে বিদায় দিতেন। হেঁটে কিংবা অন্য কোনো বাহনে সওয়ার হয়ে নৌপথে রওনা হতেন আর সমুদ্রপথে হজ কাফেলায় যোগ দিতেন।
কাবার পথে আজকাল সর্বাধুনিক ব্যবস্থাপনা চালু হয়েছে। বিমানবন্দরে হজযাত্রীদের দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা আমাদের মুসলিম ঐতিহ্য ও জাতিসত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। হজ সংক্রান্ত এসব অব্যবস্থাপনা ও প্রতারণা বহির্বিশ্বে মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এক সময়ের আরব বেদুইন ডাকাত ও লুণ্ঠনকারীরা হয়তো এখন আর নেই, কিন্তু আরবের মরুপথের দুর্ভোগ এখন দেশের বিমানবন্দরগুলোতে স্থানান্তর হয়েছে। মরুপথের বেদুইন লুণ্ঠনকারীদের জায়গায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিভিন্ন কৌশলে কিছু লুণ্ঠনকারীর আবির্ভাব হয়েছে। পত্রপত্রিকা খুললে লুণ্ঠিত হাজীদের বুকফাটা কান্নার ছবি দেখা যায়। এজেন্ট সেজে তাদের জালিয়তি-ফাঁদ ও লুণ্ঠনের হালনাগাদ চিত্র প্রাচীন বেদুইনদেরও হার মানায়।
প্রতি বছর সহজসরল হাজীদের সারা জীবনের পাই পাই করে সঞ্চিত অর্থ প্রতারক হজ এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে লুণ্ঠন হওয়ার কথা মিডিয়ায় প্রচার হয়। বাংলাদেশে হজযাত্রীদের সমন্বয়কারী ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বেসামাল অবস্থা, অস্তিত্বহীন, রেজিস্ট্রিবিহীন, নামসর্বস্ব ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর অভিনব প্রতারণা মক্কার পথে বাধার নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
উল্লেখ করার মতো আরও একটি ব্যাপার এই যে, ট্রাভেল এজেন্সিগুলো অবিশ্বাস্য কম দামে হজ করিয়ে আনা আর চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে হাজী ধরার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রতারণা করে গ্রুপ নেতার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও অহরহ ঘটেছে। হাজীদের খেদমত ও সহযোগিতার বিষয়টি অধিকতর ইসলাম সম্মত। এ খেদমত করার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি হজ এজেন্সি অব বাংলাদেশসহ (হাব) নানা পক্ষ জড়িত আছে, কিন্তু বছরের পর বছর পার হওয়ার পরও প্রতারকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশি হজযাত্রীদের এসব দুর্ভোগ শুধু দেশের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ নেই। হজের আনুষ্ঠানিকতা পালনে ভুল নির্দেশিকা, বিমান ভাড়াজনিত জটিলতা, হজের ময়দানে খাওয়া-দাওয়া ও বাসস্থানের অসুবিধা, হজ পালন শেষে দেশে ফিরে আসার বিড়ম্বনা- এসব কথা আমরা তিক্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হাজীদের কাছ থেকে প্রায়ই শুনতে পাই।
সরকারের কাছে আমরা আশা করব, পবিত্র হজ পালন করতে আসা মানুষ কোনোভাবেই যেন কষ্ট না পায়। তারা যে আল্লাহর ঘরের মেহমান। তারা কষ্ট পেলে আল্লাহ নারাজ হবেন।
লেখক : ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক