শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এ শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে শেখে। এজন্য গোড়াতেই শিক্ষার্থীকে শিক্ষার মূল লক্ষ্য বুঝাতে হবে। অন্যথায় সে শিক্ষার মূল পথ হারিয়ে ফেলতে পারে। সুতরাং শিক্ষার মূল লক্ষ্য কী সে সম্পর্কে একটু জানার চেষ্টা করা দরকার।
মহাকবি জন মিল্টন বলেন,দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত উন্নতি সাধনকে শিক্ষা বলে।
আল্লামা ইকবাল বলেন, শিক্ষা হচ্ছে রুহের উন্নয়ন ঘটানোর প্রক্রিয়া।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর উন্নয়নের প্রক্রিয়াই শিক্ষা।
স্যার পার্সী নান বলেন, শিক্ষার মূল ভিত্তি হবে তিনটি-
ক. ব্যক্তি চরিত্রের পুনর্গঠন,
খ. পরিপূর্ণ জীবনের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ,
গ. ভালো দেহে ভালো মন বিনির্মান।
সক্রেটিস বলেন, শিক্ষার মূল দর্শন হলো মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার।
এরিস্টোটল বলেছেন, ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করাটাই শিক্ষার মূল দর্শন।
এতক্ষণ আমরা বিভিন্ন মনীষীর যে মতামতগুলো পেয়েছি তার কয়টি গুণ আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধারণ করেছি? এ পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে এবং যতটা বাস্তবায়িত হয়েছে তার মাধ্যমে আমরা এখনও ভালো হতে পারিনি কেন? দিনের পর দিন আমাদের প্রজন্ম খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন?
এর মূল কারণ, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে শিক্ষার এমন কোন টার্গেট আমরা ঠিক করতে পারিনি। এই শিক্ষা আমাদের কী দিতে পারবে? কার জন্য শিক্ষাগ্রহণ করব? এর প্রয়োগ কোথায় কীভাবে হবে? এটা অর্জনের মাধ্যমে কেমন জাতির কোন দিকে যাবে? …. এসব প্রশ্নের সঠিক কোন জবাব নেই। সেজন্য এত কিছু শিক্ষা গ্রহণের পরও উপর তলার সীমাহীন অন্যায়, দুর্নীতি, মানুষকে ঠকানো, হত্যা, খুন, জবর দখল, আত্মসাৎ, স্বার্থপরতা, অস্ত্র ও টেন্ডারবাজি, গুম এবং বোমাবাজীসহ এ জাতীয় কোন অন্যায় থেকে দেশ আজ মুক্ত নয়।
কারণ আধুনিক যুগে শিক্ষা দর্শনের মূলমন্ত্র রাজনৈতিক। শিক্ষা অনেকটাই রাজনৈতিক মতাদর্শের বাহন মাত্র। সেখানে না থাকে ব্যক্তি বা জাতি গঠনের চিন্তা আর না থাকে মানুষের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কোন দর্শন।
এ পর্যন্ত যত শিক্ষা কমিশন হয়েছে তার কোনটিতেই শিক্ষার উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে মানুষের পরকালীন জীবনের কথা, স্রষ্টার সামনে জবাবদিহিতার কথা বলা হয়নি, বরং নেতিবাচক অনেক বিষয় শেখানো হয়।
যেমন: সুদকষা অংকের দ্বারা সে শিখতে পারে কত টাকায় তার কত লাভ, দুধে পানি মেশানোর অংকের মাধ্যমে ভেজাল ও ধোকা দেয়ার প্রবণতা শিক্ষা দেয়া , অ-তে অজগর তেড়ে আসার কারণে শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব, এসব নানাবিধ কারণে যারাই এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যাচ্ছে তারা ভালোতো করছেই না বরং যা ছিল তা একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ আামাদের হাতের নাগালেই।
অতএব আমরা যদি আমাদের নব্বইভাগ মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারী দশভাগ মানুষের লালিত মূল্যবোধ অনুযায়ী শিক্ষার দর্শন ঠিক করি তাহলে আমরা শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফল দেখতে পারব এবং দেশ ও জাতি উন্নতির শিখরে উঠতে সক্ষম হবে। সুতরাং যদি আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের উৎকর্ষ সাধন করতে চাই তাহলে যে সকল বিষয়ের সংমিশ্রণে শিক্ষা ব্যবস্থা হতে হবে তা হলো-
১. প্রতিটি বিষয় আলোচনার সময় নৈতিক দৃষ্টিকোণকে সামনে আনতে হবে, কারণ ক্রমাগত নৈতিকতার রস সিঞ্চন ছাড়া খারাপ কাজ থেকে মানুষ দূরে থাকতে পারে না।
২. কোন সাংঘর্ষিক ব্যাপার আনা যাবে না। যেমন, শিক্ষার্থী দিনের সকল ক্লাসে শিক্ষা পেল এক ধরণের, আর শেষবেলা পেল ধর্মের, যা কোন মানুষকে ভালো বানাতে পারে না। এমনিভাবে যারা চব্বিশ বছর শিক্ষার বয়স পার করল তারা কীভাবে ভালো কাজ করতে পারে? নিমগাছ লাগিয়ে তো খেজুরের রস পাওয়ার আসা করলে চলবে না।
৩. আঞ্চলিক, ভৌগোলিক ও অধিকাংশ মানুষের মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটে এমন শিক্ষাদর্শন গ্রহণ করতে হবে। অন্য জাতিকে ভালোবাসার মগজ দিয়ে অথবা অন্যের চশমা লাগিয়ে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করলে হবে না।
৪. সহশিক্ষার মাধ্যমে (প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে)পাঠদান পরিহার করতে হবে। কারণ বর্তমান বাংলাদেশের মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নৈতিকতার চরম বিপর্যয় শুরু হয়েছে। এ বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য সকলকে সহশিক্ষার বিপক্ষে আওয়াজ তুলতে হবে।
৫. শিক্ষার্থীদের পোশাকের নীতিমালা মানতে হবে। যারা যে ধর্মের অনুসারী, তাদের ধর্ম বয়সপ্রাপ্ত ছেলেমেয়ের জন্য যে ধরণের পোশাক পরতে বলেছে তা পরতে বাধ্য করা। ছেলে মেয়ে হবে, আর মেয়ে ছেলে হবে- এ সব নোংরা ও অসামাজিক প্রবণতা গ্রহণের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
৬. আমরা বর্তমানে যা শিখছি তা না আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধের আর না সেটা কোন কল্যাণের। এ শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে যে প্রজন্ম গড়ে উঠছে তাদের চিত্র হচ্ছে “ সে ভাষায় বাঙালি, ধর্মে লালন ফকির,জীবন দর্শনে মানবতাবাদী,ভাব-ভঙ্গিতে তালপুকুর, আকৃতিতে দেবদাস, চলনে – বলনে ডিজিটাল এবং দক্ষতায় অন্তঃসারশূন্য। সে আসলে কার জন্য কী করে তার কিছুই বুঝে ওঠে না । এ ধরণের শিক্ষা গ্রহণের ফলে দুনিয়া ও আখিরাত দুটো দিকই বরবাদ হয়ে যায়।
এ জাতীয় সমস্যা একদিনেই সমাধানযোগ্য নয়। এ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে শিক্ষা সংস্কারের কাজ করতে হবে।
সর্বোপরি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বপর্যায়ে যদি নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্ত করা যায় এবং তা বাস্তবায়িত করা যায় তাহলে মানবতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠাসহ একটি উন্নতমানের শিক্ষা ব্যবস্থা পাওয়া সম্ভব-
ক. ভালো সমাজ গড়ার জন্য আদর্শবান মানুষ কীভাবে হতে পারে সে নির্দেশনা সম্বলিত পাঠ্যপুস্তক রচনা করা।
খ. পারস্পরিক সহনশিলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, প্রীতি-ভালোবাসা, দয়া-অনুগ্রহ ও কল্যাণ কামনা করাসহ সবসময় সত্য কথা বলা – এ সকল বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা।
গ. পারস্পারিক পরামর্শ করা, বড়দের মর্যাদা দান ও ছোটদের স্নেহ করা এবং সৎকাজের আদেশ দেয়া অসৎ কাজে নিষেধ করা – এ বিষয়ক নির্দেশনা পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা।
ঘ. বিশেষ করে বাবা-মাকে সম্মান করা, বৃদ্ধ বয়সে তাদের সেবা করা, প্রতিবেশীর হক আদায় করা এবং পরোপকার করার পাশাপাশি অন্যান্য সকল ধর্ম ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ করা।
লেখক, ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
সহকারী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Email: rafiqdu81@yahoo.com