[এখানে সুযোগ্য গ্রন্থকার বাদ্যযন্ত্র সম্পর্কে সেই হাদীস উল্লেখ করে নি যাতে প্রিয় নবী (সা) ইরশাদ করেছেন, বাদ্যযন্ত্র মিটিয়ে ফেলার জন্যে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। বাদ্যযন্ত্র বলতে ঐ সব যন্ত্রকে বোঝায় যা দ্বারা মানুষের সুপ্ত যৌন আকাংখা জাগরিত হয়। -অনুবাদক]
যে কাজে সাধারণতঃ মানুষের মন আকৃষ্ট হয় ও অন্তর পরিতৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করে এবং কর্ণ কুহরে মধু বর্ষিত হয়, তা হচ্ছে গান বা সঙ্গীত। ইসলামের দৃষ্টিকোণ হচ্ছে, নির্লজ্জতা, কুৎসিত-অশ্লীল ভষা কিংবা পাপ কাজে উৎসাহ উত্তেজনা দানের সংমিশ্রণ না হলে সেই সাথে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারেও কোন দোষ নেই।
আনন্দ উৎসব ক্ষেত্রে খুশী ও সন্তোষ প্রকাশের জন্যে এ সব জিনিস শুধু জায়েযই নয়, পছন্দনীয়ও বটে। যেমন ঈদ, বিয়ে, হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়ের ফিরে আসা এবং ওয়ালীমা’র আকীকার অনুষ্ঠান ও সন্তান জন্ম হওয়াকালে এ সব ব্যবহার করা যেতে পারে দ্বিধাহীন চিত্তে।
হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন, আনসার বংশের এক ব্যক্তির সাথে একটি মেয়ের বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ হে আয়েশা! ওদের সঙ্গে আনন্দ-স্ফূর্তির ব্যবস্থা কিছু নেই? কেননা আনসাররা তো এগুলো বেশ পছন্দ করে। (বুখারী)
হযরত আয়েশা (রা) তাঁর এক নিকটাত্মীয় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন আনসার বংশের এক ছেলের সাথে। তখন নবী করীম (সা) এসে জিজ্ঞেস করলেন, দুলহিনকে কি পাঠিয়ে দিয়েছ? লোকেরা বলল, জ্বি হ্যাঁ। বললেনঃ তার সাথে একটি গায়িকা মেয়ে পাঠিয়েছ কি? লোকেরা বললঃ জ্বি না। তখন তিনি বললেনঃ
আনসার বংশের লোকেরা খুব গান পছন্দ করে। এ কারণে দুলহিনের সাথে তোমরা যদি এমন একটি মেয়ে পাঠাতে যে গাইতঃ আমরা তোমাদের কাছে এসেছি, আমরা তোমাদের বাড়ি এসেছি, আল্লাহ আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখুন, তোমাদেরও, তাহলে খুবই ভাল হতো। (ইবনে মাজা)
হযরত আয়েশা (রা) বলেনঃ তাঁর কাছে উপস্থিত থেকে দুটি মেয়ে ঈদুল-আযাহা’র দিনে গান গাইতেছিল ও বাদ্য বাজাচ্ছিল। নবী করীম (সা) কাপড়মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। এ সময় হযরত আবূ বকর (রা) তথায় উপস্থিত হলেন। তিনি এ দেখে মেয়ে দুটিকে ধমকালেন। নবী করীম (সা) তা শুনে মুখের কাপড় খুলে বললেনঃ হে আবূ বকর, ওদের করতে দাও। এখন তো ঈদের উৎসব সময়। (বুখারী, মুসলিম)
ইমাম গাজালী তাঁর ‘ইহয়া-উল-উলুম’ গ্রন্থে দুটি মেয়ের গান গাওয়া সংক্রান্ত বহু কয়টি হাদীসের উল্লেখ করেছেন। মসজিদে নববীতে হাবশীদের খেলার ও নবী করীম (সা) কর্তৃক তাদের উৎসাহ দানেরও উল্লেখ করেছেন। নবী করীম (সা) এ সময় হযরত আয়েশাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ তুমি কি এ খেলা দেখতে চাও? তার পরে তিনি তাঁর সঙ্গে লেগে থেকে তাকে দেখালেন এবং তাঁর এ সমস্ত হাদীসই বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হয়েছে। তা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, গান ও খেলা সম্পূর্ণ ভাবে হারাম নয়। এ ব্যাপারে শরীয়তের যে রুখছত আছে, তারও প্রমাণ বিদ্যমান।
প্রথমত, খেলার ব্যাপারটি বিবেচ্য। হাবশীদের নৃত্য ও ক্রীড়ামোদিতা সর্বজনবিদিত। দ্বিতীয়ত, তা মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হওয়া এবং তৃতীয়ত, রাসূলে করীম (সা) কর্তৃক তাদের বাহবা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা দান প্রভৃতিই এসবের মুবাহ হওয়ার প্রমাণ। আর এ সব যখন রয়েছে, তখন তাকে কি করে হারাম বলা যেতে পারে?
চতুর্থ ব্যাপার হচ্ছে, হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর তাদের নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু নবী করীম (সা) উভয়কে বারণ করে তা চলতে দিলেন এবং কারণ দর্শালেন এই বলে যে, এটা ঈদ উৎসব। এইটা আনন্দস্ফূর্তি করার সময়। এ গুলোই হচ্ছে আনন্দ-স্ফূর্তি লাভের সামগ্রী।
পঞ্চম কথা, তা দেখার জন্যে নবী করীম (সা)-এর দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে থাকা এবং হযরত আয়েশার সাথে আনুকূল্য করতে গিয়ে তাঁর নিজেরও শোনা। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্ত্রীলোক ও বাচ্চাদের খেলা দেখিয়ে তাদের আনন্দ দান করা উত্তম চরিত্রসম্পন্ন কাজ। কৃচ্ছ্রতা ও পরহেজগারীর শুস্কতা কঠোরতা গ্রহণ করে তা থেকে বিরত থাকা বা তা করতে না দেয়া- অন্যদের তা থেকে বিরত রাথার তুলনায় এ কাজ অনেক ভাল।
ষষ্ঠ হচ্ছে, তিনি শুরুতেই হযরত আয়েশাকে বললেনঃ
তুমি কি দেখতে চাও?
আর সপ্তম হচ্ছে, দুটো মেয়েকে গান গাইতে ও বাদ্য বাজাতে অনুমতি দান।
বহু সংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ীন গন শুনেছেন এবং তাতে কোন দোষ মনে করেন নি, একথা নির্ভরযোগ্য সূত্রে উদ্ধৃত হয়েছে। এ পর্যায়ে বর্ণিত নেষেধমূলক হাদীসগুলো সমালোচনার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। তার কোন একটিও এমন নয়, যার সম্পর্কে হাদীস বিজ্ঞানী ও ফিকাহবিদগণ আপত্তি তোলেন নি। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ গান হারাম হওয়ার পর্যায়ে কোন একটি হাদীসও সহীহ্ নয়। ইবনে হাজম বলেছেনঃ এ পর্যায়ের সব বর্ণনাই বাতিল ও মনগড়া রচিত।
গান এ বাদ্যযন্ত্র সাধারণত উচ্চ পর্যায়ের বিলাস-ব্যসন ও শান-শওকতপূর্ণ অনুষ্ঠানাদিতে, মদ্যপানের আসরে ও রাত্রি জাগরণের মজলিসসমূহে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এ করণে বহু আলিম তাকে হারাম বা মাকরূহ বলেছেন। আর অন্যান্য আলিমগণ মনে করেন, কুরআনের ভষায় এ গান-বাজনা সেই ‘লাহউল হাদীস’ যার কথা এ আয়াতে বলা হয়েছে-
লোকদের মধ্যে এমনও আছে, যারা ‘লাহউল-হাদীস’ ক্রয় করে, যেন তারা লোকদের আল্লাহর পথ থেকে কোনরূপ ইলম ছাড়াই ভ্রষ্ট করে দিতে পারে। আর যেন তারা আল্লাহর পথকে ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করে। এ লোকদের জন্যে খুবই অপমানকর আযাব রয়েছে।
ইবনে হাজম বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘লাহউল-হাদীস’ গ্রহণ করে এ আয়াতটি তার পরিচিতিস্বরূপ বলেছে যে, সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে কাফির। কেননা সে আল্লাহর পথকে ঠাট্টাও বিদ্রুপ করে। সে যদি কোন বই ক্রয় করে লোকদের ভ্রষ্ট করে ও আল্লহর পথকে ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করে, তাহলে সে নিঃসন্দেহে কাফির। আল্লাহ্ তা’আলা উপরিউক্ত আয়াতে তার দোষের কথা বলেছেন। সে লোকের দোষ বলেন নি, নিন্দা করেন নি, যে লোক ‘লাহউল হাদীস’ কে লোকদের ভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে নয়, কেবলমাএ খেলা তামাসা-স্ফূর্তি করার উদ্দেশ্যে খরিদ করে এবং তার দ্বারা স্বভাব মেজাজের সুষ্টতা ও সন্তুষ্টি বিধান করে।
যাঁরা বলেন যে, গান ঠিক নয়, তা অবশ্যই ভ্রষ্টতা, তাদের প্রতিবাদ করে ইবনে হাজম লিখেছেন, রাসূলে করীম (সা) বলেছেন, কার্যাবলীর ভাল-মন্দ নির্ভর করে নিয়তের ওপর। কাজেই যে লোক এ নিয়তে গান শুনল যে, তার দ্বারা গুনাহের কাজে উৎসাহ পাওয়া যাবে, তাহলে সে ফাসিক। পক্ষান্তরে যে লোক স্বভাব-মেজাজের সুষ্ঠতা লাভের উদ্দেশ্যে শুনল, আল্লাহনুগত্যমূলক কাজে শক্তি সাহস পাওয়ার এবং ভাল ও সৎকাজে আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে শুনল, তার এ কাজ নিশ্চয়ই অন্যায় বা বাতিল নয়। আর যে ব্যক্তি না আল্লাহনুগত্যের নিয়তে শুনল, না নাফরমানী নিয়তে, তার এ কাজ নিষ্ফল কাজের পর্যায়ে গণ্য। তা আল্লহ্ মাফ করে দেবেন। যেমন কারো বাগানে, খোলা মাঠে বা নদী-তীরে পায়চারী করার জন্যে বের হওয়া শুধু প্রাতঃ ভ্রমণ ও সন্ধ্যাকালীন বিহার করার উদ্দেশ্যে নিজ বাড়ির দরজায় বসে থাকে আমোদ-প্রমোদ ও শিথিলতা সম্পাদনের জন্যে অথবা নিজের কাপড় হড়িৎ, সবুজ বা অন্য কোন বর্ণে রঞ্জিত করা ইত্যাদি।
তবে গানের ব্যাপারে কয়েকটি জিনিসের দিকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে-
১. গানের কথা বা বিষয় বস্তু ইসলামী শিক্ষা ও ভাবধারা পরিপন্থী হতে পারবে না। মদ্যের গুণ বর্ণনাকারী বা মদ্যপানে আমন্ত্রণকারী গান অবশ্যই হারাম। কেননা তা থেকে হারাম কাজ করার প্রেরণা পাওয়া যায়।
২. অনেক সময় দেখা যায়, গান হয়ত ইসলামী ভাবধারা পরিপন্থী নয়, কিন্তু গায়কের সঙ্গীত-ঝংকার ও পদ্ধতি হালালের সীমা ডিঙ্গিয়ে হারামের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। যেমন খুব হাস্য-লাস্যময়ী ও লজ্জাষ্কর অঙ্গভঙ্গি সহকারে, হেলে দুলে, নির্লজ্জতার ধরন অনুসরণ এবং হৃদয়াবেগে তুফানের উত্তেজনা ও আলোড়নের সৃষ্টি করে, লালসা উদ্দীপক ও দুর্ঘটনা সঙ্ঘটকরূপে তা উপস্থাপন করে।
৩. দ্বীন ইসলাম সর্বব্যাপারেই বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনমূলক আচরণের বিরোধী। ইবাদতের ব্যাপারেও এই কথা। লাহউন-এর ব্যাপারেও কোনরূপ সীমালঙ্ঘন বরদাশত যোগ্য নয়া। তাতে খুব বেশি সময় ব্যয় করা কখনই উচিত নয় অথচ সময়ই হচ্ছে জীবনের মূলধন।
সন্দেহ নেই, বৈধ কাজে সীমালংঘন ও বাড়াবাড়ি করা হলে প্রকৃত কর্তব্য সম্পাদনের ত্রুটি থাকা খুবই স্বাভাবিক। এ কারণে যথার্থই বলা হয়েছেঃ
বাড়াবাড়িকে আমি এমন অবস্থায় দেখেছি যে, তার সম্মুখে প্রকৃত সত্য মার খেয়ে যাচ্ছে, বিনষ্ট হচ্ছে।
৪. কোন কোন গান শুনে ব্যক্তি নিজের কাছ থেকেই ফতোয়া পেয়ে যেতে পারে, সে গান শুনে হৃদয়াবেগ যদি উত্তেজিত হয়ে উঠে থাকে এবং তাতে বিপদ ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে- আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে পাশবিকতার প্রাধান্য হতে দেখা যায়, তাহলে তা অবশ্যই পরিহার করা উচিত এবং যে দুয়ার থেকে বিপদের হাওয়া আসে, তা বন্ধ করে দেয়া কাঞ্ছনীয়।
৫. এ ব্যাপারে সকলেই একমত যে, যে গানের সাথে মদ্যপান, ফষ্টিনষ্টি ও চরিত্রহীনতার মতো কোন হারাম জিনিসের সংমিশ্রণ হয়, সে গান হারাম। এ বিষয়ে নবী করীম (সা) কঠিন আযাবের দুঃসংবাদ শুনিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, আমার উম্মতের কিছু সংখ্যক লোক মদ্যপান করবে এবং তার আসল নামের পরিবর্তে নতুন ও ভিন্নতর নাম রেখে দেবে। তাদের শীর্ষদেশে বাদ্য বাজানো হবে, গায়িকারা গান গাইবে। আল্লাহ্ জমিনে তাদের ধ্বসে দেবেন এবং ওদের কতিপয়কে বানর ও শূকর বানিয়ে দেবেন। (ইবনে মাজাহ)।
এই কথানুযায়ী বিকৃতিটা আকার-আকৃতিতে আসা জরুরী নয়। এ বিকৃতি মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়েও হতে পারে অর্থাৎ মানব দেহের বানরের আত্মা ও মানসিকতা এবং শূকরের রূহ বিরাজ করবে। অন্য কথায় আকৃতিতে মানুষ কিন্তু প্রকৃতিতে বানর ও শূকর। [ মনে রাখতে হবে গ্রন্থকার এখানে গান মুবাহ হওয়ার পক্ষে যা লিখেছেন তার জন্যে এমন সব শর্তের উল্লেখ করেছেন, যা পালন করা খুবই দুষ্কর। অথচ আমাদের দেশে ও সমাজে সাধারণত যে সব গান শোনা বা শোনানো হয়, যে সব ফিল্মের গান প্রচার করা হয় তা উক্ত শর্তে উত্তীর্ণ হতে পারে না। কাজেই এগুলো জায়েয হওয়ার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। কেননা এগুলো হচ্ছে নির্লজ্জতা ও যৌনতা প্রচার-প্রসারের বড় মাধ্যম। নৈতিকতার জন্যে তা বড়ই মারাত্মক। গায়ক, গায়িকারা গান গেয়ে নারী-পুরুষদের মুগ্ধ বিমোহিত করে। অথচ ইসলাম নৈতিক পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছে। কোন নারীর পরপুরুষের সাথে অথবা পুরুষের পরনারীর মধুমিশ্রিত মোলায়েম কন্ঠে কথা বলাও জায়েয রাখা হয়নি। কুরআন মজীদে তা স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে। ভিন পুরুষ মেয়েলোকের মধুর কন্ঠস্বর স্বাদ গ্রহণকে ইসলামে ব্যভিচার বলে অভিহিত করা হয়েছে। অতএব এসব গান যে হারাম তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। তবে প্রকৃত ইসলামী ভাবধারা সৃষ্টিকারী ও জিহাদী তেজোবীর্য উদ্বোধক গানের মুবাহ হওয়াও সর্বজনস্বীকৃত।-অনুবাদক ]
লেখক: আল্লামা ইউসূফ আল-কারযাভী
অনুবাদ: মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম