মহান আল্লাহাতায়ালা বলেন, (হে রাসূল) আপনি বলুন, ‘আমার প্রভুর কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রভুর কথা শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্র (সমুদ্রের কালি) নিঃশেষ হয়ে যাবে- সাহায্যার্থে এরকম আরেকটি সমুদ্র এলে তা-ও’ (সূরা-কাহাফ-১০৯)।
মহান আল্লাহর বাণী পবিত্র কোরআনের আলোর প্রভাবের প্রখরতা ও শক্তি এত বেশি, তা কোনো সৃষ্টিই একে সহ্য করার ক্ষমতা রাখে না, এমনকি পাহাড়-পর্বত পর্যন্ত এর বোঝা বহন করতে সক্ষম নয়।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি যদি এ কোরআনকে পর্বতের ওপর অবতীর্ণ করতাম তবে নিশ্চয়ই তুমি (হে নবী) দেখতে পেতে, তা আল্লাহর ভয়ে নত হয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে।’ (সূরা হাশর-২১)।
অথচ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি প্রিয় মানুষ জাতির ওপর এর বোঝা বহন এবং সংরক্ষণের দায়িত্ব-ক্ষমতা দান করলেন। যাদের ওপর এ মহাগ্রন্থ আসমানি কিতাবের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তারা হলেন- সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ, মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দা- ‘হাফেজে কোরআন’।
যারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সুমধুর বাণীকে মুখে উচ্চারণ করে, স্মৃতিতে ধারণ করে, আপন হৃদয়ের গহিনে গেঁথে রেখে, এর হিফাজত করছেন। আর তা হচ্ছে, মহান আল্লাহতায়ালা মানবজাতির প্রতি এক অশেষ নিয়ামত; যা হচ্ছে তাঁর অফুরন্ত দয়া ও রহমত যার কোনো শেষ নেই।
আল্লাহতায়ালার পরম দয়ায় মৌমাছি যেমন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক তৈরি করে, তা থেকে নিজেরাও এর স্বাদ গ্রহণ করে এবং মানুষ জাতিও এর মাধ্যমে বিশেষভাবে উপকৃত হয়। তেমনিভাবে ‘হাফেজে কোরআনও মহান আল্লাহর সুমধুর ঐশী বাণী সমগ্র কোরআনকে নিজেদের স্মৃতিতে ধারণ করে সারা জীবন এর আলোতে আলোকিত হন এবং অন্য সব মুমিন-মুসলিম ভাইদের হৃদয়েও এর আলো ছড়িয়ে দেন।
মহাপুণ্যের মাস, মুক্তির মাস, মুমিনদের বেশি বেশি পুণ্য অর্জনের মাস মাহে রমজান। যে মাস সম্পর্কে প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, এ মাসের প্রথম অংশ (মহান আল্লাহর) রহমত, এর মাঝের অংশ মাগফিরাত (ক্ষমা) এবং শেষের অংশ দোজখ থেকে নিষ্কৃতি বা মুক্তি। এ মাসেই রয়েছে মহাসম্মানিত রাত মুক্তির রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আর তা হচ্ছে, ‘লাইলাতুল কদর’ আর এ রাতেই অবতীর্ণ হয়েছিল মহাপবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো একটি দল আল্লাহর কোনো ঘরে (মসজিদে) সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কোরআন) তিলাওয়াত করলে এবং নিজেদের মধ্যে তার অধ্যয়নের ব্যবস্থা করলে অবশ্যম্ভাবীরূপে তাদের ওপর প্রশান্তি নাজিল হয়। রহমত তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, ফেরেশতারা নিজেদের ডানা মেলে তাদের ওপর ছায়া বিস্তার করে এবং আল্লাহর কাছে যারা থাকেন তাদের মধ্যে তিনি (আল্লাহ) তাঁর আলোচনা করেন।
তা হলে বাস্তবে আমরা সহি মুসলিমে দেখতে পাই, হাফেজে কোরআন যেভাবে মানুষের হৃদয়ে এবং মুমিনদের অন্তরে পবিত্র কোরআনের আলো ছড়িয়ে দেন, তাতে তাদের প্রতি মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও প্রশান্তি বর্ষণ হতে থাকে। তাই তারা মহান আল্লাহর প্রিয়বান্দা এবং সার্বিক কল্যাণের অধিকারী। তাই তাদের প্রতি আমাদের সুন্দর আচরণের মাধ্যমে দয়ার্দ্রচিত্ত প্রদর্শন করতে হবে এবং নম্র, ভদ্র ও বিনীয় হয়ে তাদের সম্মান দেখাতে হবে। তবেই মহান আল্লাহতায়ালা আমাদের প্রতিও রহমত, বরকত এবং ক্ষমা প্রদর্শন করবেন।
মহাপুণ্যের মাস রমজানে যখন হাফেজে কোরআন তারাবির নামাজে মুসল্লিদের পবিত্র কোরআন পড়ে শোনান এবং তারা শোনে, তখন মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাদের প্রতি বর্ণনাতীতভাবে রহমত ও বরকত নাজিল হতে থাকে। যাকে অন্যান্য হাদিসে সাকিনা বা প্রশান্তি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালার এ মহাসম্মানিত ব্যক্তিদের অবশ্যই সার্বিকভাবে সাহায্য, সহায়তা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা দিয়ে আদর-আপ্যায়ন করা এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একান্তভাবেই আমাদের কাম্য।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হাফেজে কোরআনদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে বাঁধা উট। মালিক তার রক্ষণাবেক্ষণ করলে সে ঠিক বাঁধা থাকে, আর তাকে ছেড়ে দিলে সে চলে যায়।’ (সহি বুখারি, সহি মুসলিম)।
মহান আল্লাহ সুন্দরকে পছন্দ করেন। তাঁর বাণীগুলো সুন্দর। তাই কোরআনকে আমাদের সুন্দরভাবে, মধুর স্বরে ও সুললিত কণ্ঠে তিলাওয়াত করা জরুরি।
আবু লুবাবা বশির ইবনে আবদুল মুনসির (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি সুললিত কণ্ঠে (সুন্দর ও সুমুধর স্বরে) কোরআন পাঠ করে না সে আমার দলভুক্ত নয়।’
হে মহান আল্লাহ। মহাগ্রন্থ আল কোরআন এবং এর হিফাজতকারী হাফেজে কোরআনদের যেন আমরা পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করতে পারি সেই শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও সমাজসেবক