প্রায় ৪০ বছরপর্যন্ত পাক-পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, সম্ভ্রান্ত, ভদ্র ও নীতি-নিয়মের জীবন যাপন করার পর কোলাহলমুক্ত দূর পাহাড়ের উচ্চ শিখরে জনমানবশূন্য এক গুহায় আশ্রয় নেন। একাকীত্ব ও নীরবতার মধ্যে দিনে পর দিন অতিবাহিত হতে থাকে রোযা ও ধ্যানমগ্ন অবস্থায়।
এ অবস্থায় সহসা এক মহাবিপ্লব সাধিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর অন্তরে এমন এক আলোকোচ্ছটা বিচ্ছুরিত হয় যা তিনি মুহূর্তকাল পূর্বেও কল্পনা করতে পারেননি।তাঁর ভেতর দুনিয়া এক মহাশক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। তিনি সশব্দে উচ্চারণ করেন-
ইক্বরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযী খালাক। খালাকার ইনসানা মিন আলাক। ইক্বরা ওয়া রাব্বুলকাল আকরাম। আল্লাযী আল্লামা বিলকালাম। আল্লামাল ইনসানা মা লাম ইয়া লাম।
পাহাড়ের গুহা থেকে নেমে সরাসরি বাড়িতে ফিরে এলেন। প্রথমে তিনি কিছুটা হতচকিত হলেন, ঘাবড়ে গেলেন। বুদ্ধিমতী স্ত্রীর অভয়দানে ও তাঁর প্রশংসা বাণীতে, ওয়ারাকার বিশ্লেষণে তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন। (প্রথম ওহী নাযিল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য সহীত আল-বুখারীর ৩ নং হাদীস পাঠ করা যেতে পারে।)
তিনি তাঁর সমাজের মানুষের মধ্যে ঘোষণা দিলেন, তোমরা তোমাদের একমাত্র স্রষ্টা, মালিক, মনিব আল্লাহর দাসত্ব করো এবং তাঁর অনুগত হও। নিজেদের হাতে গড়া যেসব ইট-পাথরের মূর্তির সামনে তোমরা অবনত হওয় সেগলো একদম অসার, অবাস্তব, অবান্তর। এই চাঁদ, সূর্য, তারকা, গাছপালা, পশু-পাখি সবই এক আল্লাহর সৃষ্টি। তোমরা এগুলো সামনে মাথা নত করো না। তোমরা মানুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। সৃষ্টির সবকিছুই তোমাদের সেবায় নিয়োজিত।
সকল মানুষ এক সমান। কেউ অপমানের কালিমা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। কেউ কৌলিন্যের তকমা নিয়েও পৃথিবীতে আসেনি। ধার্মিকতা ও কৌলিন্য বংশ-গোত্রের মধ্যে নয়, বরং আল্লাহর ইবাদত, সৎকাজ, সদাচার, নীতি-নৈতিকতা, তাকওয়া ও পবিত্রতার মধ্যে নিহিত। যার মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্য নেই সে মানুষ নামের অমানুষ।
তোমাদের মৃত্যু অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী, চিরসত্য। তোমাদের পূর্বপুরুষ কেউ বেঁচে নেই। তোমাদের সকলকে আল্লাহর দরবারে হাযির হতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে পৃথক পৃথকভাবে নিজের কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। এই কার্যকলাপের ভিত্তিতেই আখেরাতের জীবনে তোমাদের পরিণতি নির্ধারিত হবে। কেবল ঈমান ও সৎকাজের সম্পদই কাজে আসবে।
এই ছিল সেই পয়গাম যা নিয়ে তিনি আলোর পর্বতের গুহা থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর মূর্খ-জাহিল জাতি তাঁর দুশমন হয়ে গেল। তারা তাঁকে গালি দেয়। পাগল বলে, কবি ও যাদুকর আখ্যা দেয়, পথভ্রষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করে। তাঁর প্রতি থুথু নিক্ষেপ করে, পাথর বর্ষণ করে, উটের পঁচা নাড়ীভুঁড়ি তাঁর গলায় পেঁচিয়ে দেয়।
একদিন দুইদিন নয়, দীর্ঘ তেরোটি বছর ধরে অবর্ণনীয় নির্মম যুলুম-অত্যাচারের শিকার হন তিনি ও প্রাণ উৎসর্গকারী মুষ্টিমেয় তাঁর একনিষ্ট অনুসারীগণ।
শেষ পর্যন্ত খালি হাতে অজান্তে অজ্ঞাতে গভীর অন্ধকারে তিনি দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন।
কেনো? কী কারণে? কী ছিল তাঁর অপরাধ? অর্থ-সম্পদ নিয়ে তো কোনো বিরোধ ছিল না। খুনের অপরাধের কোনো দাবিও ছিল না। তাঁর অপরাধ ছিল অন্যকিছু।
তিনি কেন এক আল্লাহর ইবাদত করতে বলেন, মূর্তিপূজা ত্যাগ করতে বলেন। কেন ধার্মিকতা ও সদাচার শিক্ষা দেন, মদপান, যেনা-ব্যভিচার, পরস্ব অপহরণের বিরুদ্ধে কেন রুখে দাঁড়ান। মানুষের মধ্যকার উঁচু-নীচুর ব্যবধান কেন ঘুচিয়ে দেন। গোত্রীয় ও বংশীয় আভিজাত্য ও সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতাকে কেন জাহিলিয়াত (মূর্খতা-কুসংস্কার) আখ্যা দেন।
জাতি তাঁকে হুমকি দেয়, তুমি এই যেসব কথা বলছো তা সবই আবহমান কালের গোত্রীয় ঐতিহ্য ও জাতীয় নীতি-নিয়মের পরিপন্থী। তোমার প্রচারকার্য বন্ধ করো। অন্যথায় আমরা তোমার বেঁচে থাকা কঠিন করে দেব। [চলবে]
লেখক: মাওলানা মুহাম্মদ মূসা, তাফসীরকারক